ড্রয়িং রুমে রাখা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি টেলিভিশনটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন রহমান সাহেব। আশির দশকের শেষ দিকে যখন ঢাকার ঘরে ঘরে সাদাকালো টিভি কেনার হিড়িক পড়েছিল, তখন ছোট্ট একটা টেলিভিশন কেনার ভীষণ শখ ছিল তার। সে আমলে টেলিভিশন ছিল বড়লোকদের জিনিস, তার মত একজন বাস ড্রাইভারের এ স্বপ্ন ছিল রীতিমত আকাশ কুসুম কল্পনা। তবে টিভি কিনতে না পারলেও বসে ছিলেন না রহমান সাহেব, সময় পেলেই ছুটে যেতেন কাকরাইল মোড়ে রাজমণি সিনেমা হলে। চোখে পানি আনা সেই সিনেমাগুলোর কাহিনী আজও ভোলেন নি তিনি।
টেলিভিশনটা অবশ্য রহমান সাহেবের নিজের টাকায় কেনা না। ইদানিং কিছুই আর নিজের টাকায় কিনতে হয়না। এটা পাঠিয়েছে গাবতলী বাস টার্মিনালের ঠিকাদার জগলু। এ বছরও বাস টার্মিনালের টেন্ডার পেয়েছে জগলু, তাই এই উপহার। জগলুর মাথায় বুদ্ধি আছে বলতে হবে, সঠিক সময় সঠিক উপহারটা পাঠিয়েছে সে। কাল থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু আর আজকে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি টিভি, সত্যিই জগলুর তারিফ করতে হয়।
গুলশান তিন নম্বরের এই ফ্ল্যাটটাও রহমান সাহেব নিজে কেনেন নি। বছর দুয়েক আগে রাজউকের চেয়ারম্যানকে ফোন করে সরকারী লেকের বিশ কাঠা জমিতে ষোল তলা একটা এপার্টমেন্টের প্ল্যান পাশ করে দিয়েছিলেন রহমান সাহেব। পরদিনই ডেভেলপার কোম্পনীর মালিক বাসায় হাজির ফ্ল্যাটের চাবি আর কাগজপত্র নিয়ে। ফ্ল্যাটটি রহমান সাহেবের স্ত্রী শাহেদা বেগমের ঠিক মনমত হয়েছে, পাক্কা ছাব্বিশ শ স্কয়ার ফুট। রাতের বেলা ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে বাইরে তাকালে শহরের লাল-নীল ঝিকিমিকি আলো যেন স্বপ্নের মত মনে হয়।
রহমান সাহেবের চারটি গাড়ি - একটি নিজে ব্যবহার করেন, আরেকটি স্ত্রী শাহেদা বেগম। বাকী দুটি দুই ছেলে আরমান ও আজিজের দখলে। আরমান আর আজিজ দুই তিন মাস পরপরই গাড়ি চেঞ্জ করে, তবে এর জন্যে রাহমান সাহেবকে কোন টাকাপয়সা খরচ করতে হয় না। প্রতি মাসেই কেউ না কেউ নতুন নতুন গাড়ি দিয়ে যায়। গত সপ্তাহেই টেট্রাকন ফার্মাসিটিকালস কোম্পানীর মালিক নতুন একটা পাজেরো দিয়ে গেছে। তবে পাজেরো মডেলটি রহমান সাহেবের কাছে কেমন যেন পুরোনো মনে হয়, তাই ঠিক করেছেন অন্য কোন নতুন মডেলের গাড়ি দিয়ে যেতে বলবেন। এই কোম্পানির জন্যে তো কম করেন নি তিনি, গত মাসে সরকারী হাসপাতালে কলেরার ট্যাবলেটের মধ্যে যখন কেবল মাত্র ময়দার গুঁড়া ধরা পড়ল, তখন তিনিই তো বাঁচিয়েছেন ওই কোম্পানীকে।
তবে অন্য সবার মত ঘুষ খান না রহমান সাহেব। ঘুষ খাওয়া অপরাধ - এই নীতিবাক্য অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন তিনি। আর তাই কারো কাছ থেকে নিজে চেয়ে কিছু নেন না তিনি, মানুষজনই স্বেচ্ছায় এসে দিয়ে যায়। তাই একে ঘুষ বলা যায় না। সৎ, সহজ-সরল মানুষ হিসাবে রহমান সাহেবের একটা ইমেজ আছে। গত নির্বাচনের আগে এলাকাবাসীর মুখে মুখে ছিল একটাই স্লোগান - সৎ প্রার্থী একটাই , রহমান ভাই রহমান ভাই।
ঘুষের ব্যাপারে শাহেদা বেগমও খুব সচেতন, তাই জেনে শুনে কখনো ঘুষ খান না। রহমান সাহেব তাকে বাসার পাশের খুব নামী-দামী এক স্কুলের গভর্ণিং বডির সভাপতি বানিয়ে দিয়েছেন। অভিভাবকরা বাসায় এসে বাচ্চার স্কুলে ভর্তির জন্য টাকাপয়সা দিয়ে যায়। শাহেদা বেগমের কাজ শুধু নাম নোট করে রাখা, বাকী কাজ স্কুলের হেডমাস্টারই করে্ন। টাকা পয়সার হিসাবও আগে থেকে হেডমাস্টার ঠিক করে রাখেন। ভর্তির সময় স্কুলের হেডমাস্টার এসে নামের লিস্ট নিয়ে যান, চা-নাস্তা খেয়ে যান। প্রত্যেকের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নেন শাহেদা বেগম। এর মধ্যে চার লাখ নিজের কাছে রাখেন, আর বাকী দু'লাখ স্কুলের হেডমাস্টার ও অন্যান্যরা ভাগাভাগী করে নেন। গত বছর এভাবে পুরো স্কুলে সাড়ে ছয়শ ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করেছেন তিনি। তবে যেহেতু শাহেদা বেগম কারো কাছ থেকে জোর করে বা চেয়ে চিন্তে টাকা নেন না, তাই এই টাকাকে একেবারেই ঘুষের টাকা বলা যাবে না। আর হালাল টাকায় যাকাত ফরজ বলে গত রমজানে শাহেদা বেগম আটশ সুতীর শাড়ী কিনে বিলিয়ে দিয়েছেন গরীব-দুঃখীদের মাঝে।
রাতে বিছানায় শুয়ে রহমান সাহেবের যখন ঘুম আসে না, তখন অতীতের সব কাহিনী একের পর এক মনে পড়তে থাকে। রহমান সাহেব ফেলে আসা সেসব অতীতের কথা কখনোই মনে করতে চান না, তবুও কেন যেন বারবার মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে মিরপুর বারো নম্বর লাইনের বাস ড্রাইভার কেরামত আলীর কথা।একসাথে দুজন কত সিনেমা দেখেছেন, চকবাজার থেকে পাগলা পানি কিনেছেন।
রহমান সাহেবের উত্থানের গল্প নিয়ে রীতিমত একটা সিনেমা বানিয়ে ফেলা যায়।এই গল্পের শুরু মিরপর দুই নম্বর লাইনের গাড়ি চুরি থেকে, আর শেষ এখনো বাকী। তারা তিন ড্রাইভার মিলে পরিবহনের তিনটি বাস চুরি করলেন। নতুন বডি আর নম্বরপ্লেট লাগিয়ে শুরু করলেন পরিবহনের ব্যাবসা, গুলিস্থান থেকে মাওয়া আর মাওয়া থেকে গুলিস্তান। রমরমা ব্যবসা, বছর কয়েকের মধ্যেই পরিবহনের গাড়ি সংখ্যা দাঁড়ালো দশে। আর দেরি করলেন না রহমত সাহেব। একে একে দুই পার্টনারকে সরিয়ে দিলেন, একাই হয়ে উঠলেন মালিক। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাকে। দশ বছরের মধ্যে সারা দেশে ছাপ্পান্নটা রুটে সাড়ে তিনশ গাড়ী নামল রহমান সাহেবের। আর বড় বড় নেতাদের ধরে হয়ে গেলেন বাস মালিক সমিতির সভাপতি।
ইলেকশনে এমপি হবার জন্য লড়লেন রহমান সাহেব। টাকা দিয়ে হাত করলেন এলাকার সব ছোটবড় নেতাদের, আর ভাড়া করে নিয়ে এলেন শ'পাঁচেক সন্ত্রাসী। আর ঠেকায় কে, বিপুল ভোটে জয়ী হলেন রহমান সাহেব। পরের ইলেকশনে দল ক্ষমতায় এলে দলের ফান্ডে বিশ কোটি টাকা অনুদান দিয়ে মন্ত্রী হয়ে রীতিমত সাড়া ফেলে দিলেন তিনি। বিশ কোটি টাকা এভাবে খরচ করাতে বিশাল কোন ক্ষতি হয়নি রহমান সাহেবের, গত দুই বছরে এর কয়েকগুণ কামিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে এত কিছুর মাঝেও রহমান সাহেবের হঠাৎ হঠাৎ অকারণেই মনে পড়ে সেই কেরামত আলীর কথা। কেরামত আলীই তাকে বাস চালানো শিখিয়েছিল।
রহমান সাহেবের যত চিন্তা সব ছোট মেয়ে শিলাকে নিয়ে, কেন যেন পরিবারের অন্য সবার মত হয় নি সে। আরমান আর আজিজের মত নতুন মডেলের গাড়ী আর সিঙ্গাপুর-ব্যঙ্কক গিয়ে শপিং-এর কোন আগ্রহ নেই তার মাঝে। ভার্সিটির কিছু চাষাভূষার ছেলেমেয়ের সাথে মিশে কিসব কাজ করে বেড়াচ্ছে - বস্তির ছেলেমেদের ক-খ-গ-ঘ শিখাচ্ছে, মানুষজনের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে শীতের কাপড় জোগাড় করে বস্তিতে বিলিয়ে বেড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পরতো সোসাইটির কারো সামনে মুখই দেখাতে পারবেন না রহমান সাহেব। এতদিনে রহমান সাহেব বুঝতে পেরেছেন যে করিম সাহেবের কথা না শুনে মেয়েকে সরকারী ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে কি বিশাল ভুল তিনি করেছেন।
যেভাবে হোক শিলার বিয়েটা এবার দিতেই হবে, পার্টির মহাসচিব খোকন ভাই তার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। ছেলেও একদম মনমত। ছেলে ভার্সিটির ভিপি ছিল, সামনের বার এমপি ইলেকশনে দাঁড়াবে। আর এ বিয়ে হলে পার্টিতে রহমান সাহেবের অবস্থান আরো শক্ত হবে, প্রভাব-প্রতিপত্তি বহুগুনে বেড়ে যাবে। তবে শিলাকে রাজী করানোটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। আগেও বহুবার শিলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু শিলা বিয়ের কথা শুনলেই ক্ষেপে যায়, নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
শিলা ভার্সিটির এক চাষাভূষার ছেলেকে পছন্দ করে - গরম চায়ে ফুঁ দিতে দিতে সেদিন সকালে বোমাটা ফাটালেন শাহেদা বেগম। রহমান সাহেব আগেই আন্দাজ করেছিলেন, তাই খুব বেশি অবাক হলেন না। রহমান সাহেব অবশ্য ব্যাপারটাকে খুব বেশি পাত্তা দেন নি, তিনি খুব ভালো করে জানেন ছেলেকে ডেকে কিছু কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিলে আর শিলার ধারে কাছে ঘেঁষবে না।
শিলার কাছ থেকে ছেলের নাম, ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর জোগাড় করলেন শাহেদা বেগম। ছেলের নাম রাহাত, শিলার সাথে একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। এই ছেলেই মাথা খেয়েছে শিলার, জনসেবার ভুত ঢুকিয়েছে শিলার মাথায়। রহমান সাহেব ফোন করলেন রাহাতকে, বাসায় আসতে বললেন। রাহাত আসলো, রাহাতকে দেখে অবাক হলেন না রহমান সাহেব, যেমনটা ধারণা করেছিলেন, ঠিক তেমনই। রঙ ওঠা সূতির শার্টের সাথে সস্তা কাপড়ের একটা প্যান্ট পড়েছে রাহাত। এমন ছেলেকে কি দেখে শিলা পছন্দ করল তা কোনভাবেই বুঝে পাচ্ছিলেন না রহমান সাহেব। রাহাত বসল, রাহাতের পাশের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলেন রহমান সাহেব। পকেট থেকে জার্মানী থেকে আনা মার্লবোরোর প্যাকেটটা বের করলেন রহমান সাহেব, সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, "কি যেন নাম তোমার?" রাহার মাথা নিঁচু করে উত্তর দিল, "রাহাত"। এস্ট্রেটা নিজের দিকে টেনে নিলেন রহমান সাহেব, সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে আবার জিজ্ঞেস করলেন, "বাবার নাম কি?"। রাহাত খুব মলিনভাবে উত্তর দিল, "কেরামত আলী"। হঠাৎ করেই চমকে উঠলেন রহামান সাহেব, কেন যেন হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। নিজেকে একটু শান্ত করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, "বাবা কি করে?"। ফ্লোরের দামী টাইলসগুলোর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উত্তর দিল রাহাত, "বাস চালায়, মিরপুর বারো নম্বরে"।
আর কোন কথা বলেলেন না রহমান সাহেব, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ড্রয়িং রুমে রখা অ্যাকুরিয়ামটার দিকে। মনে করার চেষ্টা করলেন অতীতের অনেক কথা, যা কোন দিনই মনে করতে চান না তিনি। কানে বাজতে থাকল রাজমণি হলে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময় কেরামত আলীর সেই কথা, "রহমান, বিয়াডা কইরা ফালাও তাড়াতড়ি। তোমার মাইয়া হইলে, তোমার মাইয়ার লগে আমার পোলার কিন্তু বিয়া দেয়নই লাগবো"।